নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ কদমতলী এমডব্লিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী স্বপ্না আক্তারের (১৪) বস্তাবন্দি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের আজ ১৫ দিন হয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে এই হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। পরিবারের দাবি গত ৩০ এপ্রিল থেকে স্বপ্না নিখোঁজ। তবে স্বপ্নার নিখোঁজের বিষয়টি এলাকার কেউ জানতেন না এবং স্বপ্নার বাবা-মাও সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় এ বিষয়ে জিডি বা কোন অভিযোগ করেনি। নিখোঁজের তিনদিন পর ২ মে স্বপ্নাদের বাড়ির বসতঘরের ১০ মিটার দূরত্ব একটি পরিত্যক্ত যায়গা থেকে স্বপ্নার বস্তাবন্দি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের দুই দিন পর হত্যার কোনো ক্লু না পেয়ে গত ৪ মে নিহতের মা শাহিন আক্তার নেহা বাদি হয়ে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন থানায়। মামলা দায়েরের ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও স্বপ্নার খুনিকে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ।
এদিকে স্বপ্নার মৃত্যুর রহস্য ঘিরে এলাকায় চলছে নানা গুঞ্জন। সোস্যাল মিডিয়া ফেসবুকে বিচার দাবি করেছেন এলাকার যুবক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। সজল খান, গোলাম মোহাম্মদ খান, নূরহোসেন খান আরও অনেকেই ফেসবুকে ‘স্বপ্না আক্তার হতাার বিচার চাই’ দাবিতে সোচ্চার। এ নিয়ে স্কুলের শিক্ষকদেরও দায়ী করছেন কেউকেউ। গোলাম মোহাম্মদ খান লিখেছেন ‘এমন নৃশংসভাবে হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানাই কারা এই হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত? খুনিরা কিন্তু আকাশ থেকে আসেনি, মেয়েটিকে কেউ একা খুন করেনি, একের অধিক এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত এটা আমার চির বিশ্বাস! খুনিরা যদি এলাকার বাহিরের হয় তাহলে এভাবে মেরে বস্তায় বন্দি করে বাড়ির পাশে না রেখে শুধু হত্যা করেই চলে যেত!!আমার একান্ত বিশ্বাস খুনিরা আশেপাশেই লুকিয়ে নয় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
আব্দুল্লাহ আল জুবায়েদ স্ট্যাটাসে লিখেছেন,’ ধীক্কার জানাই ঔ সমস্ত শিক্ষক/শিক্ষিকাদের এবং ঔ সমস্ত অভিভাবক প্রতিনিধি সদস্যদের, যারা নিজেদের প্রয়োজনে ছাত্র/ছাত্রীদের ব্যবহার করে, এবং বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে ভোট গ্রহন করে। কিন্তু ছাত্র/ছাত্রী দের বিপদে পাশে দারায় না।
তবে এ হত্যাকান্তের ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক শওকত জামিল। তিনি বলেন, মামলাটি নিয়ে দিনরাত কাজ করছে পুলিশ। আশা করছি অতি শীঘ্রই হত্যাকারীকে সনাক্ত করে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবে পুলিশ।
এ মামলার বাদি নিহত স্বপ্নার মা শাহিন আক্তার নেহা ও বাবা দেলোয়ার হোসেন খোকা এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, স্বপ্নার লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। দুইদিন থানায় আটক রেখে আমাদেরকে মারধর করেছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এক পর্যায়ে আমাকে (মামলার বাদি শাহিন আক্তার) কে চাপ প্রোয়োগ করে,’ তার স্বামী দেলোয়ার হত্যা করেছে তা স্বীকারোক্তি দিতে’। কিন্তু আমি কোনভাবেই এই স্বীকারোক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমাকেও মারধর করা হয় বলে তার অভিযোগ। পুলিশ হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে না পেরে এবং এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার না করায় শেষ পর্যন্ত তাদের দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানায় মামলার বাদি শাহিন আক্তার নেহা। তিনি বলেন, যদি আমার স্বামী দেলোয়ার হোসেন আমার মেয়েকে হত্যা করে থাকে তাহলে পুলিশ প্রমাণ করুক যে তিনি হত্যা করেছে। যদি আমার স্বামী এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকে তাহলে আমিও তার ফাঁসি চাই।
গতকাল বুধবার সরেজমিনে নিহত স্বপ্নার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বপ্নার ৬ বছর বয়সি ছোট বোন অনামিকা মায়ের কোলে বসে আছে। ছোটবোনের ‘অনামিকা’ নামটি স্বপ্নাই রেখেছিলেন বলে জানায় স্বপ্নার মা। অনামিকার সাথে কথা বলতে চাইলে ছোট শিশুটি যেন বোনের মৃত্যুতে একেবারেই নির্বাক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে ভয়ে। বড় বোনের পড়ার একটি বই এনে দিয়ে বলে এটা আমার আপুর বই। আপু স্কুলে গেছে। স্বপ্না হত্যার বিচার চাইতে বাবা দেলোয়ার হোসেন ব্যস্ত ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে সকালে স্কুল প্রাঙ্গণ গেটে মানববন্ধন হবে তা নিয়ে। এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে সব শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী যেন এই মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করে। স্বপ্নার মা মেয়ের মৃত্যুতে কাঁদবে নাকি মেয়ের হত্যার বিচার চাইবে তা নিয়েও চিন্তায় রয়েছেন কারণ পুলিশের সন্দেহের তির তাদের দিকে। স্বপ্নার শোবার টিনের ঘরটি পরে আছে খালি। স্বপ্নার ঘর থেকে লাশ উদ্ধারের স্থানের দূরত্ব প্রায় ১০ মিটারের কমবেশি। পুলিশ যে স্থান থেকে স্বপ্নার লাশ উদ্ধার করেছে তার পাশেই স্বপ্নার দাদির পরিত্যক্ত ঘরটি খালি পরে আছে। দাদির মৃত্যুর পর সেই ঘরটিতে কেউ থাকে না ওভাবেই পরিত্যক্তভাবে রয়েছে। সেই ঘরটিতে একটি খাট, তার ওপর তোশক ও কিছু সোফার ফোম রাখা রয়েছে। সেই ঘরটির জানালায় একটি গ্রিল লাগানো ছিল সেটি একটি সিটকিনি দিয়ে আটকানো ছিল চাইলেই এটা যে কেউ খুলে বাইরে যেতে পারবে।
ঘটনার দিন ৩০ এপ্রিল স্বপ্না বাড়ি থেকে স্কুলড্রেস পরে যাওয়া-আসার একটি সিসিটিভি ফুটেজ এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যায়, ৩০ এপ্রিল সকাল ৬টা ৩৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ডে স্কুল ইউনিফর্ম পরে কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে হেঁটে বের হয়ে যাচ্ছে স্বপ্না। প্রায় তিন ঘণ্টা পর সকাল ৯টা ৪৮ মিনিটে রিকশাযোগে বাড়ির সামনে এসে নেমে রিকশা ভাড়া দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। এরপর এই পথ দিয়ে স্বপ্নাকে আর বের হতে বা প্রবেশ করতে দেখা যায়নি।
এদিকে পুলিশ হত্যার কোনো ক্লু না পাওয়ায় হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে না পারায় এলাকাবাসী আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কে হত্যা করলে স্বপ্নাকে? কি কারণে হত্যা করলো স্বপ্নাকে? এলাকায় সাধারণ জনমনে না প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্কুলের অভিভাবকদের মনে না প্রশ্নে জর্জরিত আতঙ্কিত তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিয়ে। হত্যাকারী সনাক্ত ও গ্রেফতার না হওয়ায় নিহত স্বপ্নার পরিবারকে নিয়ে আজ সকাল ১০ টায় স্বপ্নার স্কুল এমডব্লিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের গেটের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেছে ‘প্রতিশ্রুতি জনকল্যায়ন সংস্থা’ নামক একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি স্বর্ণালি বলেন, অষ্টম শ্রেণির একজন স্কুলছাত্রীর অর্ধগলিত বস্তাবন্দি লাশ পাওয়ায় আমরা অভিভাবকরা আতঙ্কিত। আমাদেরও সন্তান আছে তারা স্কুলে পড়াশোনা করে। লাশ উদ্ধারের আজ ১৫ দিন হয়ে গেলেও হত্যাকারীকে চিহ্নিত বা গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। হত্যাকারী গ্রেফতার না হওয়ায় আমরা এলাকাবাসী খুবই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। কে বা কারা হত্যা করল স্বপ্নাকে কি কারণে হত্যা হলো স্বপ্না আমরা সেই খুনিকে দেখতে চাই এবং তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তিনি আরও বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমি নিজে এই উদ্যোগ নিয়েছি। এভাবে যেন আর কোন মায়ের বুক খালি না হয়। এমন নৃশংসভাবে কেউ যেন খুন না হয়। আমরা চাই পুলিশ যেন এই হত্যাকারীকে দ্রুত সনাক্ত করে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনুক। আমরা ‘অবিলম্বে স্বপ্না হত্যার বিচার চাই’ দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় নিহত স্বপ্নার স্কুল প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করবো স্বপ্নার পরিবারকে সাথে নিয়ে।
স্বপ্নার স্কুল এমডব্লিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রওশন আরা বলেন, স্বপ্না আক্তার ৮ম শ্রেণীর খ শাখায় অধ্যায়নরত ছিলেন। শুনেছি গত ২ মে স্বপ্নার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্কুলের শ্রেণী শিক্ষকদের সাথে পুলিশ, র্যাব এসে কথা বলে গেছেন এ বিষয় নিয়ে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো: মোজাম্মেল হক জানান, স্বপ্না হত্যাকান্ডে পুলিশের একাধিক টিম কাজ করছে। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই হত্যার রহস্য উদঘাটন হবে এবং হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হবো।
মামলাটি নিয়ে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-১১’র একটি দল ছায়া তদন্তে নেমেছে। এ বিষয়ে র্যাব-১১’র অধিনায়ক তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় স্কুলছাত্রীর বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি জানতে পেরেছি। মরদেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্টটি হাতে এলে মৃত্যুর অনেক তথ্য জানা যাবে। এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের সনাক্ত করতে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব-১১’র একটি দল ছায়া তদন্ত করছে। ##